পর্ব: ১] আমরা হাদিস কেন মানতে বাধ্য?

 

মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলা পবিত্র কোরআন মাজীদের ১৬ নং সূরা আন নাহলের ৪৪ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:

بِٱلۡبَيِّنَٰتِ وَٱلزُّبُرِۗ وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ
অর্থঃ তাদের প্রেরণ করেছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন ও গ্রন্থসহ এবং তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা ভাবনা করে।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]
[We sent them] with clear proofs and written ordinances. And We revealed to you the message [i.e., the Quran] that you may make clear to the people what was sent down to them and that they might give thought." [Translator: Sahih International]

তাহলে এই আয়াতটা গভীর ভাবে লক্ষ্য করুন? মহান আল্লাহ বলছেন:-"তাদের প্রেরণ করেছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন- (بِٱلۡبَيِّنَٰتِ) ও গ্রন্থসহ- (وَٱلزُّبُرِۗ) । এখানে "তাদের" সর্বনাম দ্বারা পূর্ববর্তী নবীগণকে বোঝানো হয়েছে যাঁদের কে মহান আল্লাহ স্পষ্ট নিদর্শন ও গ্রন্থসহ পাঠিয়েছিলেন। এখন নিদর্শন টা কী ঐ কিতাবে সরাসরি সুবিস্তারিত ভাবে বর্ণিত ছিল??? অবশ্যই না বরং তা কোন নবীর মাধ্যমে সরাসরি কোন অলৌকিক কাজ করে দেখানো হয়েছিল যাকে বলা হয়েছে "স্পষ্ট নিদর্শন" যা মহান আল্লাহ তাদের কে দেখিয়েছিলেন; এরপর ওয়া দ্বারা আলাদা করে বলা হয়েছে "وَٱلزُّبُرِۗ/and the books এবং গ্রন্থসমূহ। অর্থাৎ আলাদা ভাবে গ্রন্থ তথা কিতাব সমূহ। এরপরের লাইনে বলা হয়েছে "وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ/And We revealed to you the message that you may make clear to the people অর্থাৎ (হে মুহাম্মদ সাঃ) তোমার প্রতি কোরআন- (ٱلذِّكۡرَ/যিকর্অবতীর্ণ করেছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য- (لِتُبَيِّنَ/that you may make clear).

উল্লেখ্য যে এই আয়াত নাযিলের পেছনে একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে। এখন প্রেক্ষাপট হচ্ছে আয়াত নাযিলের পেছনে কোন কারণ সমূহ; যা পবিত্র কোরআনে পাওয়া যায় না বরং এসব প্রেক্ষাপট জানার জন্য সহীহ হাদিস জানা প্রয়োজন। কেননা হাদিসে কোরআনের আয়াত নাযিলের কারণ সমূহের বর্ণনা পাওয়া যায়। আর আমরা জানি কোন কিছু ঘটার পেছনে একটা কারণ দায়ী থাকে অন্যথায় তা ঘটবে না। যেটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে Laws of Causality. আর মহান আল্লাহ্ তা'আলাও কোন কারণ ছাড়াই আয়াত নাযিল করেননি। যেটা যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বোঝা যায়। কোন কিছুর প্রেক্ষাপট না জানলে ঐ বিষয় সম্পর্কে ততটা ভাল করে জানা এবং বোঝা সম্ভব নয়। এখন যারা সহীহ হাদিস অস্বীকার করে তাদের থেকে এই আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট দলিল ভিত্তিক যৌক্তিক প্রমাণ চাই, আল্লাহ্ কেন এই আয়াত নাযিল করলেন? কী এমন কারণ ছিল যার জন্য তাঁকে এমন আয়াত নাযিল করতে হল? কোন মনগড়া ধারণা প্রসূত দলিল বিহীন কথা গ্রহণযোগ্য নয়। তো যাইহোক এই আয়াত সম্পর্কে আসা যাক।

তাহলে আমরা উক্ত আয়াত কে পয়েন্ট আকারে দেখি:
i) তাদের প্রেরণ করেছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন ও গ্রন্থসহ;
ii) তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য

আমরা (ii) নং পয়েন্ট সম্পর্কে কথা বলব। এইখানে সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে :-"তোমার প্রতি [কোরআন- (ٱلذِّكۡرَ/যিকর্)] অবতীর্ণ করেছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। এখানে আরবি শব্দ "لِتُبَيِّنَ" ব্যবহার করা হয়েছে যেটা একটা Verb যার অর্থ: that you may make clear/যাতে আপনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন।"

এখানে প্রশ্ন হলো:
১) পবিত্র কোরআন পড়েই যদি সব কিছু ঢালাওভাবে বিস্তারিত বোঝা সম্ভব হতো তাহলে মহান আল্লাহ্ কেন রাসূল ﷺ কে কোরআন বুঝিয়ে দিতে বললেন? এর অর্থ বোঝায় পবিত্র কোরআনে এমন সব বিষয় রয়েছে যা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এই যেমন সালাত কত রাকাত, কখন আদায় করতে হবে, কোন পদ্ধতি বা নিয়মে আদায় করতে হবে; হজের আনুষ্ঠানিকতা কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে করতে হবে বা হবে না, যাকাত কিভাবে, কতটুকু দিব, কিভাবে এর বন্টনমালা জারি করব? সিয়াম তথা রোযা কিভাবে পালন করব ইত্যাদি ইত্যাদি। আর রাসূল ﷺ কোরআনের এসব নির্দেশিত বিষয়ে যা সুস্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিবেন তা কোন ভাবেই কোরআনের ভেতর ঢালাওভাবে উপস্থিত থাকা সম্ভব নয় হাদিস ছাড়া যা লজিক্যাল কথা। কেননা তা যদি কোরআনে সুস্পষ্ট ভাবে বিস্তারিত থাকত তাহলে আলাদা করে রাসূল ﷺ কে কোরআন বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলতেন না মহান রব। কারণ রাসূল ছাড়াই যদি কোরআন সুস্পষ্ট বোঝা যেত তাহলে মহান আল্লাহ ১৬:৪৪ নং আয়াতের দ্বিতীয় পয়েন্ট নাযিল করতেন না। আবার রাসূল পাঠানোরও দরকার ছিল না। 

আর যদি আমরা নিজেরাই কোরআন পড়ে সব বুঝতে পারি তাহলে রাসূলের দরকারটাই বা কী? যেখানে আপনি নিজেই কোরআন বোঝানোর জন্য বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারবেন সেখানে রাসূল ﷺ কেন ব্যাখ্যা করতে পারবেন না? এটা কী সম্ভব হয়, যাঁর উপর কোরআন নাযিল হয়েছে সে কোরআন বোঝানোর জন্য ব্যাখ্যা করবেন না অথচ আপনিই কিনা ১৪০০+ বছর পরে কোরআন বোঝানোর জন্য ব্যাখ্যা করবেন? অর্থাৎ এটাও অযৌক্তিক।
২) পবিত্র কোরআনে কী এমন বিষয় সরাসরি বিস্তারিত উল্লেখ নেই যার জন্য মহান আল্লাহ্ ঐ বিষয় সম্পর্কে রাসূল ﷺ কে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে বললেন???
৩) কোন কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার কথা তখন-ই আসতে পারে যদি না ঐ বিষয় সম্পর্কে কোরআনে কেবলমাত্র সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়া ঐ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য না থাকে। এই যেমন সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি। এসব পবিত্র কোরআনের কোথাও বিস্তারিত আসে নাই বিধায় মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূল ﷺ কে তা সুস্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিতে বলেছেন। আর তিনিও আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আর এসব জানার একমাত্র উপায় হলো রাসূল ﷺ এর সহীহ হাদিস যা কিনা তাঁর সাহাবীগণের থেকে বর্ণিত হয়েছে।

এই যেমন আমরা পবিত্র কোরআনের কোন কথা বোঝার জন্য কাউকে প্রশ্ন করি ঠিক তেমনি সাহাবীগণও পবিত্র কোরআন সম্পর্কে রাসূল ﷺ এর কাছে প্রশ্ন করত। কেননা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো নতুন কোন কিছু সম্পর্কে বেশি বেশি প্রশ্ন করে জেনে নেওয়া, তা বুঝা। ঠিক তদ্রুপ সাহাবীগণও কোরআন বোঝার জন্য রাসূল ﷺ কে প্রশ্ন করে, তা সম্পর্কে বুঝে নিতেন। আর এসব-ই পরবর্তীতে সাহাবীগণ বর্ণনা করেছেন যা সহীহ হাদিস নামে পরিচিত। আর যদি দ্বীনের ক্ষেত্রে এসবের কোন মূল্যায়ন না থাকত তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল ﷺ সাহাবীগণের কাছে কোন জবাব দিতেন না।

৪) তথাকথিত আহলে কোরআন দাবিদারদের কাছে প্রশ্ন: আপনারা যখন কোরআন বোঝানোর জন্য বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করান তখন এর অর্থ নিশ্চিত বলবেন," অন্যদের কোরআন বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দাঁড় করাই।" ঠিক তদ্রুপ রাসূল ﷺ তাঁর সাহাবীগণকে কোরআন বোঝানোর জন্য কোন ব্যাখ্যা করেন নাই এটা কি করে হয়??? যার উপর কোরআন নাযিল হয়েছে সে ব্যাখ্যা করতে পারবে না অথচ আপনিই কিনা সেই ১৪০০+ বছর পরে নতুন থিওরি অব অ্যামিউজমেন্ট অর্থাৎ বিনোদন মূলক তত্ত্ব দিবেন এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে??? 


Comments

  1. সালামুন আলাইকুম খান সাহেব আপনার লেখাটি পড়লাম খুব মনোযোগ সহকারে. সালাত যাকাত হজ্ব রোজা কুরবানী বিষয়ে কোরআনে স্পষ্ট এই বিধানগুলো প্রাক্টিসেস এর বর্ণনা নেই.আয়াতের উদ্বৃতি এবং আপনার বক্তব্য অনুযায়ী এই পদ্ধতিগুলো আল্লাহ শিখিয়ে দিয়েছেন ওহি জিবরীল আমিনের মাধ্যমে. এই যৌক্তিক বক্তব্যটি অনুসন্ধানে কোরআনের একটি আয়াত খুঁজে পাওয়া যাবে না বরং সূরা আলে ইমরানের 144 নং আয়াত ও সূরা হাক্কা হওয়ার 43 থেকে 47 নং আয়াত এর উদ্বৃতি দিয়ে আপনার এই বিষয়টিকে বা মন্তব্যটি কে রোধ করে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। আল-ই-ইমরান ও সূরা হাক্কাহর আয়াতের বক্তব্য আল্লাহর এবং এই বক্তব্য অনুযায়ী নবীজি কেবলমাত্র বার্তাবাহক বা রাসুল নতুন কোন বিধান আইন প্রণেতা হিসেবে নবীজির ক্ষমতাকে রহিত করা হয়েছে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

আরবি دحا (daha),বা ধাতু دحو(dah-un) শব্দের অর্থ কী?

কোরআন মানতে গিয়েই সহীহ হাদিস মানতে বাধ্য কেন?