পবিত্র কোরআন কী বলে-চাঁদের আলো প্রতিফলিত আলো?
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
বিষয়: পবিত্র কোরআনে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি সিরিজ।
পবিত্র কোরআনে চাঁদের আলো সম্পর্কে কী বলা হয়েছে? এটার কী নিজস্ব আলো আছে নাকি নেই? আসুন এ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যাক:
প্রাচীন সভ্যতাগুলো বিশ্বাস করত যে, চাঁদ নিজেই নিজের আলো ছড়ায় কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান আজ আমাদের বলে যে, চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই বরং চাঁদের যে আলো তা হলো প্রতিফলিত আলো অর্থাৎ (Reflection Light)। আর মহিমান্বিত ঐশীগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআন ১৪০০+ বছর আগে থেকেই এই ধ্রুবক সত্য বৈজ্ঞানিক তথ্যটি আমাদের কে জানিয়ে দিয়েছে ২৫ নং সূরা আল ফুরকান (الفرقان), আয়াত: ৬১-তে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন:-
تَبَارَكَ ٱلَّذِى جَعَلَ فِى ٱلسَّمَآءِ بُرُوجًا وَجَعَلَ فِيهَا سِرَٰجًا وَقَمَرًا مُّنِيرًا
অর্থঃ কত মহান তিনি, যিনি নভোমন্ডলে সৃষ্টি করেছেন তারকারাজি এবং তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ ও জ্যোতির্ময় চাঁদ!" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]
Blessed is He who has placed in the sky great stars and placed therein a [burning] lamp and luminous moon." [Translator: Sahih International]
[উল্লেখ্য https://www.hadithbd.com/ এ তিন জনের অনুবাদ দেওয়া হয়েছে।
১. আল-বায়ান:...আর তাতে প্রদীপ ও আলো বিকিরণকারী চাঁদ সৃষ্টি করেছেন।
২. তাইসীরুল:...আর তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ আর আলো বিকিরণকারী চন্দ্র।
৩. মুজিবুর রহমান:....এবং তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ ও জ্যোতির্ময় চাঁদ!"
৪. Sahih International:....and placed therein a [burning] lamp and luminous moon."
আবার পবিত্র কোরআন মাজীদের ৭১ নং সূরা নূহের ১৬ নং আয়াতে মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলা এরশাদ করেছেন:
وَجَعَلَ ٱلۡقَمَرَ فِيهِنَّ نُورًا وَجَعَلَ ٱلشَّمۡسَ سِرَاجًا
অর্থঃ এবং সেখানে চাঁদকে স্থাপন করেছেন আলোক রূপে ও সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপ রূপে।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]
And made the moon therein a [reflected] light and made the sun a burning lamp." [Translator: Sahih International]
উপরোল্লিখিত ২৫:৬১ নং আয়াতে "وَّ جَعَلَ فِیۡهَا سِرٰجًا وَّ قَمَرًا مُّنِیۡرًا" [ওয়া জা'আলা ফিহা সিরা-জাও ওয়া ক্বমারন মুনীর্] বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে। তো এখানে দুইটি আরবি শব্দ "سِرَٰجًا" এবং "وَقَمَرًا" ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ a lamp বা প্রদীপ (সূর্য) এবং and a moon (চাঁদ). তাহলে এই আয়াতে একটা বিষয় লক্ষণীয়। আর তা হলো সূর্যের বৈশিষ্ট্য হিসেবে একে প্রদীপ তথা a lamp এবং চাঁদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে একে "مُّنِيرًا/মুনীর্" তথা shining/luminous বা উজ্জ্বল বলা হয়েছে।
এছাড়া ইংরেজি অনুবাদের দিকে লক্ষ্য করুন? ইংরেজিতে "a [burning] lamp and luminous moon" অনুবাদ করা হয়েছে।
সূর্যের জন্য:
ব্রাকেটের ভেতরে বার্নিং- burning যেটা মূলত adjective শব্দ, যার অর্থ জ্বলন্ত বা জ্বলে উঠা অর্থাৎ যা নিজে জ্বলে (তাপ উৎপন্ন করতে পারে এমন কিছু) সেটাকেই ইংরেজিতে বার্নিং বলা হয়। এখানে বোঝানোর সুবিধার্থে ব্রাকেটে এই শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। আর Lamp মানে হচ্ছে প্রদীপ। আর প্রদীপের বৈশিষ্ট্য কী? এতে আগুন জ্বলে উঠে যাকে বলতে পারি প্রদীপের আগুন। আর এইখানে প্রদীপটা আগুনের উৎস হিসেবে কাজ করছে, ঠিক যেমনটা সূর্য আলোর উৎস হিসেবে কাজ করে। আর বার্নিং এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। যেমন:
Burning (adj): জ্বলন্ত, তীব্র, দহনকর, জ্বলিত, দাহক, দহন, ভস্মীকরণ ইত্যাদি প্রতিশব্দ হতে পারে। আর এইখানে উল্লেখিত প্রতিটি শব্দ-ই সূর্যের জন্য কার্যকর বৈশিষ্ট্য হিসেবে কাজ করে। উল্লেখ্য যে এসব বৈশিষ্ট্য জনিত আলোর তাপে পানি জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়।
চাঁদের জন্য:
চাঁদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে এর জন্য ইংরেজি অনুবাদে "luminous/shining" শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা মূলত adjective. আর এর অর্থ উজ্জ্বল, আলোকদায়ক অর্থাৎ যার নিজের আলো নেই কিন্তু অন্যের সাহায্যে আলোকিত হতে পারে, এমন বস্তুকে আলোকোজ্জ্বল বলা হয় ঠিক যেমনটা চাঁদ, সূর্যের মাধ্যমে আলোকিত হয় যাকে বলা যায় মৃদু আলো অর্থাৎ যে আলোতে কোন তীব্র তাপ নেই বা ঝলসে যাওয়া সৃষ্টি করতে পারে না। এই শব্দের অনেক অর্থ হতে পারে যা চাঁদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে কাজ করে। যেমন: ঝলমলে, আলোকদায়ক, স্নিগ্ধোজ্জল, প্রভাময়, জ্যোতির্ময় ইত্যাদি হতে পারে।
বিস্তারিত বর্ণনা:
পবিত্র আল কোরআনে ব্যবহৃত সূর্যের জন্য আরবি প্রতিশব্দ হল: الشَّمْسَ/সামস্ [পবিত্র কোরআন ৬:৭৮,৯৬; ৭:৫৪; ১৩:২; ১৪:৩৩ সহ মোট ৩০+ আয়াত দ্রষ্টব্য]। আবার সূর্য কে উল্লেখ করা হয়েছে: السراج/সিরাজ"-বলে যার অর্থ হলো "মশাল" অথবা "ওয়াহাজা অর্থাৎ الشَّمْسَ"- বলে যার অর্থ "প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ "-(যার নিজের আলো আছে) বা "ضِيَا۬ءً /দিয়া" হিসেবে যার অর্থ "তেজস্কর"। আর এই তিনটি বর্ণণাই সূর্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য/যথোচিত ও মানানসই। যেহেতু এটা অন্তর্দহনে তীব্র তাপ ও আলো উৎপাদন করে।
চাঁদের জন্য ব্যবহৃত আরবি প্রতিশব্দ হলো الْقَمَرَ "কামার্" [পবিত্র কোরআন ৬:৭৭,৯৬; ৭:৫৪; ১০:৫; ১২:৪; ১৩:২; ১৪:৩৩ সহ মোট ১৫+ আয়াত দ্রষ্টব্য] -যা কোরআনে الْقَمَرَ "মুনীর"-শব্দ দ্বারা প্রকাশ করেছে। "মুনীর"-হলো সেই বস্তু যা "নূর"- বা আলো দেয়। আবার কোরআনের বর্ণনা চাঁদের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যায়। চাঁদের বৈশিষ্ট্য হলো:-"চাঁদ নিজে কোন আলো দেয় না বরং এটা একটা নিষ্ক্রিয় বস্তু যা প্রতিফলিত করে সূর্যের আলোকে। সমগ্র কোরআনে একবারের জন্য হলেও চাঁদ কে "السراج/সিরাজ" বা "وهاج/ ওয়াহহাজা" বা "ضِيَا۬ءً দিয়া"-হিসেবে অথবা সূর্য কে نُوْرً "নূর"- বা الْقَمَرَ "মুনীর"-হিসেবে উল্লেখ করা হয় নাই। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে মহিমান্বিত আল-কোরআন "চাঁদ ও সূর্যের "-আলোর প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এরূপ আয়াত সূরা ফুরকানের ৬১ নং এবং সূরা নূহের ১৬ নং এ উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং চাঁদের আলো প্রতিফলিত আলো, যা বর্তমান বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে অথচ কুরআন তা ১৪০০+ বছর পূর্বে বলে দিয়েছে।" [পবিত্র কোরআন ১০:৫ এর তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ দ্রষ্টব্য]।
[নোট: পবিত্র কোরআনে "منير/মুনীর্" শব্দটি কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে]
সূর্য ও চন্দ্রের আলোর প্রকৃতি সম্পর্কে নিন্মে বর্ণিত আয়াতগুলো গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন যা মহিমান্বিত ঐশীগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআনে এরশাদ হয়েছে ১০ নং সূরা ইউনুস (يونس), আয়াত: ৫
هُوَ ٱلَّذِى جَعَلَ ٱلشَّمْسَ ضِيَآءً وَٱلْقَمَرَ نُورًا وَقَدَّرَهُۥ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوا۟ عَدَدَ ٱلسِّنِينَ وَٱلْحِسَابَ مَا خَلَقَ ٱللَّهُ ذَٰلِكَ إِلَّا بِٱلْحَقِّ يُفَصِّلُ ٱلْءَايَٰتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
অর্থঃ আল্লাহ এমন, যিনি সূর্যকে দীপ্তিমান এবং চাঁদকে আলোকময় বানিয়েছেন এবং ওর (গতির) জন্য মনযিলসমূহ নির্ধারিত করেছেন যাতে তোমরা বছরসমূহের সংখ্যা ও হিসাব জানতে পার; আল্লাহ এসব বস্তু অযথা সৃষ্টি করেননি, তিনি এই প্রমাণসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন ঐসব লোকের জন্য যারা জ্ঞানবান।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]
নোট: "দ্বীপ্তিমান" বলতে সেই আলোকে বোঝায় যে আলোতে তাপের তীব্রতা বেশি। যেমন সূর্য থেকে আসা আলো। উল্লেখ্য যে সূর্যের নিজের-ই আলো রয়েছে। অপরদিকে "আলোকময়" বলতে এমন আলোকে বোঝায় যে আলোতে তাপের তীব্রতা (গরম অনুভব) নেই অর্থাৎ মৃদু আলো। আর চাঁদ রাতের অন্ধকারে মৃদু আলো দেয়। আপনার বাসায় যদি তজমি জাতীয় কোন বস্তু থাকে তাহলে দেখবেন লাইটের আলোতে আলোকিত হয়ে তজমিও জ্বলজ্বল করে; ঠিক অনুরূপ চাঁদও। তাই দেখা যায় যে, মহিমান্বিত ঐশীগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআন ও বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞান সূর্য ও চাঁদের আলোর প্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান পার্থক্যের ব্যপারে সম্পূর্ণভাবে একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
Comments
Post a Comment