রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর ক্ষমা প্রার্থনার অর্থ কী?


বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
খ্রিস্টান বনাম মুসলিম সংলাপ:
বিষয়: রাসূলুল্লাহ সাঃ এর বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা অভিযোগ ও অপপ্রচারের যথার্থ জবাব
আলোচনা: রাসূলুল্লাহ সাঃ এর ক্ষমা প্রার্থনার অর্থ কী?তিনি কী পাপী ছিলেন?"(নাঊযুবিল্লাহ মিনযালিক)
মূল লেখা: উপমহাদেশের প্রখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ শায়েখ আল্লামা কিরানবী রহঃ এর লিখিত "ইযহারুল হক (সত্যের প্রকাশ) " বই থেকে সাহায্যকৃত
\__________________________________________________/
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতাহু প্রিয় ভাই ও বোনেরা। আশা করি অবশ্যই সবাই মহান আল্লাহ্ সুবহানু ওয়াতা'আলার রহমত ও দয়ায় ভালো এবং সুস্থ্য আছেন। আজকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করব যা তথাকথিত নাস্তিকরা সহ অমুসলিম খ্রিস্টান মিশনারিদের একটা প্রধান অভিযোগ সম্পর্কে, আর সেটা হলো বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাঃ পাপী (নাঊযুবিল্লাহ মিনযালিক) হওয়ার বিষয়ে তারা কোরআনের বিশেষ কয়েকটি আয়াত পেশ করে ইসলাম কে আক্রমণ করতে চায় বিশেষ করে ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টান পাদ্রী/মিশনারিরা।আর আয়াতগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো যাতে বলা হয়েছে সূরা আল মু'মিন (غافر), আয়াত: ৫৫

فَٱصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ ٱللَّهِ حَقٌّ وَٱسْتَغْفِرْ لِذَنۢبِكَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِٱلْعَشِىِّ وَٱلْإِبْكَٰرِ

অর্থঃ অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর; নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য, তুমি তোমার ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় তোমার রবের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান

"So be patient, [O Muhammad]. Indeed, the promise of Allah is truth. And ask forgiveness for your sin and exalt [Allah] with praise of your Lord in the evening and the morning." [Translator: Sahih International]


আয়াতের ব্যাখ্যা:এখানে আরবি "ذَنْب" শব্দের অর্থ ''পাপ/ত্রুটি/ভুল" বলতে এমন ছোট-খাটো ভুল-চুক যা মানবীয় দুর্বলতা অনুযায়ী ঘটে যায় এবং যেগুলোর সংশোধনও মহান আল্লাহর পক্ষ হতে করে দেওয়া হয় অথবা ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) ও একটি ইবাদত।নেকী ও সওয়াব বৃদ্ধির জন্য নবী (সাঃ)-কে ইস্তিগফার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কিংবা উদ্দেশ্য হল উম্মতের দিক নির্দেশনা যে, তারা যেন ইস্তিগফারের অমুখাপেক্ষী না হয়।" (৪০:৫৫ নং আয়াতের তাফসীরে আহসানুল বয়ান দ্রষ্টব্য)

আবার অন্যত্র আয়াতে বলা হয়েছে সূরা মুহাম্মদ (محمّد), আয়াত: ১৯

فَٱعْلَمْ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ وَٱسْتَغْفِرْ لِذَنۢبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَٰتِ وَٱللَّهُ يَعْلَمُ مُتَقَلَّبَكُمْ وَمَثْوَىٰكُمْ

অর্থঃ সুতরাং জেনে রেখ, আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই; ক্ষমা প্রার্থনা কর তোমার এবং মু’মিন নর নারীদের ত্রুটির জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং অবস্থান সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন।"
[অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

"So know, [O Muhammad], that there is no deity except Allah and ask forgiveness for your sin and for the believing men and believing women. And Allah knows of your movement and your resting place." [Translator: Sahih International]

এখানেও আরবি শব্দ "وَٱسْتَغْفِرْ" এর অর্থ :এবং ক্ষমা প্রার্থনা করুন; "لِذَنۢبِكَ" এর অর্থ: আপনার পাপ/ত্রুটির জন্য; এবং "وَلِلْمُؤْمِنِينَ" এর অর্থ:এবং মুমিনদের জন্য।

কোরআনের আরেক আয়াতে আরো বলা হয়েছে সূরা আল ফাত্‌হ (الفتح), আয়াত: ২

لِّيَغْفِرَ لَكَ ٱللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِن ذَنۢبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُۥ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَٰطًا مُّسْتَقِيمًا

অর্থঃ যেন আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটিসমূহ মার্জনা করেন এবং তোমার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন ও তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

"That Allah may forgive for you what preceded of your sin and what will follow and complete His favor upon you and guide you to a straight path." [Translator: Sahih International]

এই আয়াতের তাফসীরে আহসানুল বয়ান পড়ুন
https://hadithbd.com/quran/tafsir/?sura=48

উপরোল্লিখিত দুইটি আয়াতে যাতে বলা হয়েছে وَٱسْتَغْفِرْ لِذَنۢبِكَ (উচ্চারণ: ওয়াসতাগফির লি'যামবিকা) যার অর্থ :-"তোমার পাপ/ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো।" আর এই বাক্যের ইংরেজি অনুবাদে বলা হয়েছে : And ask forgiveness for your sin." তৃতীয় আয়াতেও ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা বলা হয়েছে।

আর এই অংশটুকু উদ্ধৃত করে ইসলাম বিদ্বেষী অমুসলিমরা বিশেষ করে খ্রিস্টান প্রচারকরা সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর মহান চরিত্রে পাপের কলঙ্ক লেপন করতে চায় ভিত্তিহীন অযৌকক্তিক কথার মাধ্যমে অপপ্রচার করে, যদিও তারা আয়াতের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝেই না এবং কী বোঝারো চেষ্টা করে না।

এখানে বাহ্যিক ভাবে আয়াতত্রয় দেখে অনেকেরই কাছে মনে হতে পারে যে, রাসূল সাঃ ছিলেন পাপী (নাঊযুবিল্লাহ মিনযালিক) ;যদিও হযরত মুহাম্মাদ সাঃ পাপী কথাটিও কুরআন, সহীহ হাদীস ও বাস্তবতার আলোকে ডাহা মিথ্যা কথা বৈ আর কিছুই নয়।কারণ সমগ্র কোরআন এবং সহীহ হাদিস সহ জাল, মওযু ,বানোয়াট হাদিস ও ইতিহাস থেকে পর্যন্ত অমুসলিম নাস্তিক কাফের মুশরিক খ্রিস্টান প্রচারক সহ কোন ইসলাম বিদ্বেষী ব্যক্তি একটি তথ্যও পেশ করে প্রমাণ করতে পারবে না যে আসলে তিনি অমুক অমুক স্থানে/সময়ে অমুক অমুক পাপ কাজ করে প্রকৃতপক্ষেই পাপী হয়েছিলেন।

যাইহোক মূল আলোচনাতে আসা যাক।এখানে খ্রিস্টান মিশনারিদের দাবি দুটি হলো:-
(i) : নবী মুহাম্মদ সাঃ পাপী ছিলেন; (নাঊযুবিল্লাহ মিনযালিক)
(ii) : এবং কোন পাপী অন্য পাপীর জন্য সুপারিশ করতে পারে না।"

আর এখানে এই দুটি দাবিই ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা তা বাইবেল থেকেই প্রমাণ করা যায়। কাজেই এই দুই মিথ্যার ভিত্তিতে যা প্রমাণ করে খ্রিস্টান মিশনারিরা তা স্বভাবতই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। যাইহোক উপরোল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যা করা যাক এখন।

এখানে উপরোল্লিখিত আয়াতে "ক্ষমা প্রার্থনা" করার কথা বলা হয়েছে যাতে মূল আরবি শব্দ "ذَنْب" ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ ভুল, ত্রুটি,দোষ,পাপ ইত্যাদি।আর একটি আরবি শব্দের অনেক অর্থ হয় অর্থাৎ এখানে মূল আরবিতে "ইযতিগফার" বা "গুফরান" শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।আরবি "গুফরান " শব্দের অর্থ আচ্ছাদন করা, আবরণ করা বা আবৃত করা (ঢেকে ফেলা)।সাধারণ অর্থে কোন খারাপ কিছুকে আবৃত করা বা গোপন করে রাখাকে "গুফরান " বলা হয়। আর "ইযতিগফার" অর্থ এই "গুফরান " তথা প্রার্থনা করা। কোন ব্যক্তির ত্রুটি,পাপ বা খারাপ দিক আবৃত তথা ঢেকে ফেলা দুভাবে সম্ভব।

প্রথমত: তাঁকে ত্রুটি,পাপ বা খারাপ কিছু থেকে রক্ষা করা বা নির্ভুল ও নিষ্পাপ হিসেবে তাঁকে রক্ষা করা।কারণ ত্রুটি ও পাপ থেকে রক্ষা করে নিষ্পাপ রাখার অর্থ মানবীয় দুর্বলতা ও প্রবৃত্তির খারাপ দিক আবৃত ও গোপন রাখার সর্বোত্তম ব্যবস্থা করা।

দ্বিতীয়ত: তাঁর থেকে ত্রুটি /পাপ/খারাপ কিছু সংঘটিত হয়ে গেলে তা আবৃত করা।

নোট: আরবি শব্দ "গুফরান" অর্থ পাপে লিপ্ত হওয়ার পরে শুধু ক্ষমা করাই নয় বরং কাউকে পাপ থেকে রক্ষা করাকেও "গুফরান" বলা হয়।
"গুফরান" শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো "আটকানো/সংরক্ষণ করা/রক্ষা করা/আচ্ছাদন করা/আবরণ করা বা আবৃত করা (ঢেকে ফেলা)।
এছাড়া ব্যবহারিক অর্থে আরবিতে "গাফারা" শব্দের অর্থ আবৃত বা ঢেকে ফেলা। এজন্য যুদ্ধের সময় মাথায় যে হেলমেট বা শিরস্ত্রাণ ব্যবহৃত হয়,তাকে আরবি,ফারসি ও উর্দু ভাষায় "মিগফার" বলা হয়।কারণ তা মাথাকে রক্ষা করে/মাথায় আটকে থাকে অর্থাৎ মাথাকে ঢেকে রাখে।আর এতেও প্রমাণিত হয় যে, “তোমার অতীত ও ভবিষ্যতের পাপ গুফরান করেছেন অর্থাৎ তোমাকে অতীতে ও ভবিষ্যতে পাপের কলঙ্কে নিপতিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন বা অতীতে ও ভবিষ্যতে তোমার পাপ আটকে দিয়েছেন।" আর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজের ও উম্মতের পাপ/ত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে সংরক্ষণ (গুফরান) প্রার্থনা করতেন অর্থাৎ আল্লাহ যেন আমাদেরকে পাপ থেকে সংরক্ষণ করেন বা পাপে নিপতিত হতে না দেন।"

এখন "গুফরান " ও "ইযতিগফারের" উপযুক্ত দুটি দিকের আলোকে আমরা আয়াতগুলোর যথার্থ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করব ইনশাআললাহ।

প্রথম আয়াতে পবিত্র কোরআনের ৪০ নং সূরা আল মু'মিন (غافر) এর ৫৫ আয়াতে যাতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মহান আল্লাহ্ সুবহানু
ওয়াতা'আলা এরশাদ করেছেন:-"وَٱسْتَغْفِرْ لِذَنۢبِكَ" যার অর্থ :-"তোমার পাপ/ত্রুটির জন্য "গুফরান " অর্থাৎ আবরণ/আচ্ছাদন/আবৃতি (ক্ষমা) প্রার্থনা করো।"

এবং দ্বিতীয় আয়াত তথা পবিত্র কোরআনের ৪৭ নং সূরা মুহাম্মদ (محمّد) এর ১৯ আয়াতে আল্লাহ্ আবার এরশাদ করেছেন :-"আবরণ/আচ্ছাদন বা আবৃতি (ক্ষমা) প্রার্থনা করো তোমার জন্য এবং মুমিন নর-নারীদের জন্য।"

আর এই দুই স্থানে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর ক্ষেত্রে আবরণ বা আবৃতি বা ক্ষমা প্রার্থনার কয়েক প্রকারের অর্থ হতে পারে যেমন:

ক)উক্ত আয়াতদ্বয়ে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর ক্ষেত্রে "আবৃত্তি বা ক্ষমা প্রার্থনা"র অর্থ পাপের মধ্যে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রার্থনা বা নিষ্পাপত্ব প্রার্থনা করা অর্থাৎ তোমার পাপ যেন তোমাকে স্পর্শ না করে অথবা তোমার থেকে প্রার্থনা অর্থ তাদের থেকে পাপ সংঘটিত হলে তার জন্য আবৃতি বা ক্ষমা প্রার্থনা করা।"

ইমাম ফকরুদ্দিন রাযী (রহঃ) তাঁর "তাফসীরে কাবীরে" দ্বিতীয় আয়াত তথা পবিত্র কোরআনের ৪৭ নং সূরা মুহাম্মদ (محمّد) এর ১৯ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন:-"এই আয়াতে একটি সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে। তা এই যে,"রাসূলুল্লাহ সাঃ এর তিনটি অবস্থা যেমন:

(i) আল্লাহর সাথে তাঁর অবস্থা ;
(ii) নিজের সাথে তাঁর অবস্থা এবং
(iii) অন্যান্যদের সাথে তাঁর অবস্থা।"

এখানে আল্লাহর সাথে তাঁর অবস্থার করণীয় মহান আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেওয়। তাঁর নিজের সাথে তাঁর করণীয় পাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে সংরক্ষণ প্রার্থনা করা অর্থাৎ তিনি যেন পাপের সাথে জড়িত না হয়ে পড়েন সেজন্য তাঁকে আল্লাহর সংরক্ষণ করা।আর মুমিনদের সাথে তাঁর অবস্থা এই যে,"তিনি যেন সকল মুমিন নর-নারীদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন অর্থাৎ তাঁর উম্মতকেও যেন পাপ থেকে সংরক্ষণ করানো হয় বা তারা যেন পাপ না করেন এই জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।

খ) অথবা উপযুক্ত দুই আয়াতে রাসূলুল্লাহ্ সাঃ কে তাঁর নিজের জন্য "ক্ষমা প্রার্থনার" নির্দেশ প্রদানের উদ্দেশ্য হলো এভাবে আল্লাহর দাসত্ব প্রকাশ করা ও ইবাদত পালন করা। প্রকৃতই যে তাঁর কোন পাপ ছিল বা ক্ষমা প্রার্থনার প্রয়োজন ছিল তা নয়, বরং একান্তই দাসত্ব প্রকাশের জন্য এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাসূল সাঃ কে।এছাড়া তাঁর সমসাময়িক যুগের তাঁর সবচেয়ে বড় বড় শত্রু যেমন আবু জাহেল, উতবা, শায়বা, আবু লাহাব সহ কোন কাফের মুশরিকরা পর্যন্ত বলতে পারে নাই যে,"হে মুহাম্মদ সাঃ তুমি অমুক অমুক পাপ কাজ করেছ বা পাপে লিপ্ত ছিলে যা আমরা দেখেছি বা জানি।" বরং তাঁর বড় বড় শত্রুরাও জানত যে,"মুহাম্মদ সাঃ হলেন আরবের সবচেয়ে সত্যবাদী এবং একজন ন্যায়-নিষ্ঠ সৎ লোক, যার জন্য শত্রুরাও তাঁকে আল-আমীন বলে ডাকত এবং কী তাঁর কাছে বিভিন্ন সালিশ বিচার নিয়ে উপস্থিত হতো কারণ তিনি ন্যায় বিচার করতেন।এছাড়া তাঁর কাছে কাফের মুশরিকরা পর্যন্ত সম্পদ রেখে দিত আমানত স্বরূপ। আর আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক এবং তাঁর একান্ত দাসত্ব প্রকাশ করার জন্য-ই এইরুপ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন পবিত্র কোরআনে সূরা আল ইমরান (آل عمران), আয়াত: ১৯৪

رَبَّنَا وَءَاتِنَا مَا وَعَدتَّنَا عَلَىٰ رُسُلِكَ وَلَا تُخْزِنَا يَوْمَ ٱلْقِيَٰمَةِ إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ ٱلْمِيعَادَ

অর্থঃ ‘হে আমাদের রব, আর আপনি আমাদেরকে তা প্রদান করুন যার ওয়াদা আপনি আমাদেরকে দিয়েছেন আপনার রাসূলগণের মাধ্যমে আর কিয়ামতের দিনে আপনি আমাদেরকে অপমান করবেন না। নিশ্চয় আপনি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না।" [অনুবাদক: আল-বায়ান]

এখানে "আপনি আমাদেরকে তা প্রদান করুন যার ওয়াদা আপনি আমাদেরকে দিয়েছেন আপনার রাসূলগণের মাধ্যমে/and grant us what You promised us through Your messengers."

এখানে আল্লাহ্ যা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার প্রাপ্তী তো নিশ্চিত। কারণ আল্লাহ্ তো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না" (পবিত্র কোরআন ৪:১২২; ৯:১১১; ১০:৫৫; ১৮:৯৮; ৩০:৬; ৩৯:২০; ৭৩:১৮)। কাজেই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বিষয় পাওয়ার জন্য নিষ্প্রয়োজন। এখানে আসলে প্রার্থনার একমাত্র উদ্দেশ্য প্রার্থনার মাধ্যমে দাসত্ব প্রকাশ ও আল্লাহর ইবাদত করা।অন্যত্র আল্লাহ্ প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন সূরা আল আম্বিয়া (الأنبياء), আয়াত: ১১২

قَٰلَ رَبِّ ٱحْكُم بِٱلْحَقِّ وَرَبُّنَا ٱلرَّحْمَٰنُ ٱلْمُسْتَعَانُ عَلَىٰ مَا تَصِفُونَ

অর্থঃ রাসূল বলেছিলঃ হে আমার রাব্ব! আপনি ন্যায়ের সাথে ফয়সালা করে দিন, আমাদের রব্বতো দয়াময়, তোমরা যা বলেছ সে বিষয়ে একমাত্র সহায়স্থল তিনিই।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

"হে আমার রাব্ব! আপনি ন্যায়ের সাথে ফয়সালা করে দিন/My Lord, judge [between us] in truth."

আমরা জানি যে,"আল্লাহ্ কখনোই ন্যায় ছাড়া অন্যায় অবিচার করেন না"(পবিত্র কোরআন ২:২৮১; ১৬:৩৩; ৩৯:৭৫; ৯৫:৮)। তারপরেও এই প্রার্থনার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আল্লাহর দাসত্ব প্রকাশ ও ইবাদত করা।

নোট: "ক্ষমা " অর্থও এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যাকে পাপ থেকে সংরক্ষণ তথা রক্ষা করা হলো তাকে মূলত পাপের মধ্যে নিপতিত হওয়ার কষ্ট, লাঞ্ছনা বা অসম্মান থেকে রক্ষা তথা ক্ষমা করা হলো। যেমন: আমরা অনেক সময় বলি,"এমন কাজ করতে আমাকে বলবেন না। দয়া করে ক্ষমা করবেন।" এখানে আসলে অপরাধবোধ তথা পাপের জন্য "ক্ষমা"
চাওয়া হচ্ছে না বরং ব্যক্তি ন্যায়-নিষ্ঠ বা ভক্তি দেখানোর জন্য এরুপ বলেন।

গ)অথবা এই দুই স্থানে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর ক্ষমা প্রার্থনার উদ্দেশ্য উম্মত কে শিক্ষা দেওয়া। উম্মতের সকলেই যেন তাঁর এই প্রার্থনা অনুকরণ করে ক্ষমা প্রার্থনা করে এইজন্যই তিনি এরুপ করতে নির্দেশিত হয়েছিলেন অর্থাৎ আল্লাহ্ তাঁকে প্রার্থনা করার শিক্ষা দিলেন, যেন তাঁকে অনুসরণ করে উম্মতেরাও আল্লাহর কাছে এরুপ ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে।আর বাইবেলের মধ্যেও এরুপ কথা রয়েছে যাতে যীশু তাঁর অনুসারীদের প্রার্থনা করার শিক্ষা দিয়েছেন।মথির সুসমাচারের ৬ অধ্যায়ে যীশু তাঁর শিষ্যদের যা প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েছিলেন তাঁর মধ্যে বলা হয়েছে :-

12. আর আমাদের অপরাধ সব ক্ষমা কর,যেমন আমরাও নিজের নিজের অপরাধীদেরকে ক্ষমা করেছি;13. আর আমাদেরকে পরীক্ষাতে এনো না,কিন্তু মন্দ থেকে রক্ষা কর।"(মথি ৬:১২-১৩)।

একথা সুস্পষ্ট যে,যীশু তাঁর শিষ্যদেরকে যা প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েছিলেন,তিনি সে প্রার্থনা নিজেও পালন করতেন ,তিনি বেশি বেশি প্রার্থনা করতেন।আর বাইবেলের কোন বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় না যে,তিনি তাঁর শেখানো এই প্রার্থনাটি বাদ দিয়ে অন্য প্রার্থনা করতেন।কাজেই বাহ্যত বোঝা যায় যে:-"আর আমাদের অপরাধ সব ক্ষমা কর"-বলে তিনি বহুবার প্রার্থনা করতেন।অসংখ্যবার তিনি এভাবেই প্রার্থনা করেছেন বলে জানা যায়।এখানে খ্রিস্টান মিশনারিরা কোনটা মানতে চান?
i) যীশু নিজেই অপরাধী তথা পাপী হয়ে শিষ্যদেরও ক্ষমা প্রার্থনা করার শিক্ষা দিয়েছেন ;
ii) নাকি তিনি আল্লাহর একান্ত আনুগত্য এবং দাসত্ব প্রকাশের জন্য এরুপ প্রার্থনা নিজে করেছেন এবং তাঁর শিষ্যদেরও শিখিয়েছেন?

এছাড়া পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং সকলের জন্য উত্তম আদর্শবান ব্যক্তি হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ।তাফসীরে জালালাইনে পবিত্র কোরআনের ৪৭ নং সূরা মুহাম্মদ (محمّد) এর ১৯ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :-

"রাসূলুল্লাহ সাঃ নিষ্পাপ হওয়া সত্বেও তাঁর ক্ষমা প্রার্থনার কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলেছেন যে,"তাঁর উম্মত যেন তাঁর আদর্শ অনুকরণ করতে পারে সে জন্য তিনি এরুপ নির্দেশিত হয়ে এরুপ করেছেন।"আর রাসূল সাঃ এর অনুসরণ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে সূরা আল আহ্‌যাব (الْأحزاب), আয়াত: ২১ তে এরশাদ করেছেন:-

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُولِ ٱللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُوا۟ ٱللَّهَ وَٱلْيَوْمَ ٱلْءَاخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرًا

অর্থঃ তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলের অনুসরণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

(এছাড়া রাসূল সাঃ কে অনুসরণ এবং আনুগত্য করার কথা বলা হয়েছে, পবিত্র কোরআনে ৩:৩১-৩২,১৩২; ২৪:৫২,৫৪,৫৬; ২৬:১০৮,১১০,১২৬,১৪৪,১৬৩,১৭৯; ৩৩:৩৩,৬৬,৭১; ৪৭:৩৩; ৪৮:১০; ৪৯:১৪; ৫৮:১৩; ৬০:১২; ৬৪:১২,১৬ আয়াত দ্রষ্টব্য)

"There has certainly been for you in the Messenger of Allah an excellent pattern for anyone"

উপরোল্লিখিত আয়াতে বলা হয়েছে রাসূল সাঃ এর অনুসরণে রয়েছে উত্তম আদর্শ।আর আমরা মুসলিমরা নবী মুহাম্মদ সাঃ উম্মত তথা অনুসারী। তাই কাজেই আমরা যেহেতু রাসূল সাঃ এর কাজ-কর্ম,ন্যায়-নীতি তথা জীবনাদর্শ কে অনুসরণ করে চলব তাই আমাদের জন্য রাসূল সাঃ এরুপ ক্ষমা প্রার্থনার করার বিষয়টি নির্দেশিত হয়েছিলেন, যেন আমরাও তাঁকে অনুসরণ করে এরুপ ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারি।

ঘ) অথবা এই দুই আয়াতে "তোমার পাপ/ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা" বলতে "তোমার উম্মতের পাপ" বা "তোমার বংশধরদের পাপ"কে বোঝানো হয়েছে।অথবা "তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দ্বারা প্রকৃতপক্ষে তাঁর অনুসারীদের ক্ষমা প্রার্থনা করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে" (পবিত্র কোরআন ৪০:৫৫ আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর দ্রষ্টব্য)।এখানে মূল শব্দ কে উহ্য রেখে প্রাসঙ্গিক অন্য কোন শব্দকে সম্পর্কিত হিসেবে আরবি,হিব্রু ইত্যাদি সেমেটিক ভাষাগুলোতে ব্যাপক। আসলে এ ব্যাখ্যা অনুসারে প্রথম আয়াত তথা সূরা আল মু'মিন (غافر) ৫৫ আয়াতের অর্থ হবে:-"অতএব তুমি ধৈর্য্য ধারণ করো; নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য ,তুমি তোমার উম্মতের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো।"

আর এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে দ্বিতীয় আয়াত তথা সূরা মুহাম্মদ (محمّد) ১৯ আয়াতের অর্থ হবে :-"সুতরাং জেনে রাখো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই; ক্ষমা প্রার্থনা করো তোমার বংশধর পরিজনদের জন্য এবং মুমিন নর-নারীদের জন্য।"এখানে আসলে নবী মুহাম্মদ সাঃ এর মাধ্যমে তাঁর পরিবার পরিজন এবং মুমিন নর-নারীদের ক্ষমা প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে।আর বাইবেলের মধ্যেও এরুপ কথা রয়েছে। যেমন:

21. অতএব সদাপ্রভুু তাহা শুনিয়া ক্রোধান্বিত হইলেন ; যাকোবের বিরুদ্ধে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হইল এবং ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে কোপ উঠিল"(গীতসংহিতা ৭৮:২১)।আবার বলা হয়েছে: 

28. আমি তোমাদের পবিত্র স্থানের অধ্যক্ষদের অপমান করব আর যাকোবকে ধ্বংসাত্মক নিষেধাজ্ঞার অধীন করব এবং ইস্রায়েলকে বিদ্রূপের পাত্র করব" (যিশাইয় ৪৩:২৮)। এখানে আসলে যাকোব বা ইস্রায়েল বলতে যাকোবের বংশধর বা ইস্রায়েল সন্তানগণকে বোঝানো হয়েছে।এরুপ অগণিত উদাহরণ বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান।


ঙ) অথবা আয়াতদ্বয়ে "যানব" বা "পাপ" বলতে ত্রুটি, স্থলন বা উত্তম বিষয় পরিত্যাগ করা বোঝানো হয়েছে।এছাড়া তৃতীয় আয়াতে অর্থাৎ সূরা ফাতহের ২ নং আয়াত, যাতে বলা হয়েছে :-"যেন আল্লাহ্ তোমার অতীত ও ভবিষ্যত পাপসমূহ মার্জনা করেন।"এখানে সম্পর্কিত মূল শব্দটি উহ্য রয়েছে, অর্থাৎ তোমার পাপ সমূহ বলতে তোমার উম্মতের পাপ সমূহ বোঝানো হয়েছে অথবা পাপ বলতে উত্তম বিষয় পরিত্যাগ বুঝানো হয়েছে অথবা মার্জনা বা ক্ষমা করা বলতে পাপ থেকে সংরক্ষণ বা নিষ্পাপ থাকার ক্ষমতা প্রদান করার কথা বুঝানো হয়েছে।

ইমাম সুবকী ও ইবনু আতিয়্যাহ বলেছেন:-"এই আয়াতের উদ্দেশ্য এই নয় যে,"রাসূলুল্লাহ সাঃ এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষেই কোন পাপ সংঘটিত হয়েছিল এবং আল্লাহ্ তা ক্ষমা করলেন বরং এ আয়াতের উদ্দেশ্য রাসূল সাঃ এর মর্যাদা ঘোষণা করা এবং সম্মাননা প্রদান করা। এ সূরার প্রথম থেকেই মহান আল্লাহ্ রাসূল সাঃ এর মর্যাদা এবং সম্মান বর্ণনা করেছেন। এজন্য প্রথমেই তাঁকে সুস্পষ্ট বিজয় দানের ঘোষণা দিয়েছেন।এরপর উল্লেখ করেছেন যে,এই বিজয়ের চুড়ান্ত লক্ষ্য তাঁর পরিপূর্ণ ক্ষমা ,তাঁর জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ পূর্ণ করণ, তাঁকে সরল পথে পরিচালনা করা এবং তাঁকে বলিষ্ঠ সাহায্য প্রদান করা।এখানে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর দ্বারা কোন পাপ সংঘটিত হওয়া বুঝাতে গেলে মূল বক্তব্যের সাহিত্যক ও অলঙ্কারিক গতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে।পুরো বক্তব্যের উদ্দেশ্য তাঁর সম্মান ও মর্যাদা ঘোষণা দেওয়া।যেমন মনিব তার চাকরের উপর সন্তুষ্ট হলে তাঁর কোন অপরাধ না থাকলেও বলতে পারেন ,"আমি তোমার আগে পিছের সব অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম (তোমার সাত খুন মাফ); কোন অপরাধের জন্যই আমি তোমাকে শাস্তি দিব না।

হাদিসে উল্লেখিত মুহাম্মদ সাঃ এর প্রার্থনাটির ব্যাখ্যা নিম্নরুপ:

ক) রাসূল সাঃ ছিলেন মহান আল্লাহর সর্বোচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত বান্দা এবং এ সম্পর্কে পবিত্র আল কোরআন মাজীদে মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবহানু ওয়াতা'আলা এরশাদ করেছেন সূরা আল ইনশিরাহ (الشرح), আয়াত: ৪

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

অর্থঃ এবং আমি তোমার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি"
[অনুবাদক: মুজিবুর রহমান].এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে "And raised high for you your repute." [Translator: Sahih International]

উক্ত আয়াতের তাফসীর দেখুন:
https://www.hadithbd.com/quran/link/?id=6094

এছাড়া রাসূলুল্লাহ সাঃ এর মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবহানু ওয়াতা'আলা এর বিষয়ে প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা পূর্ণতম ভাবে তিনি লাভ করেছিলেন,যতটুকু মহান রব জানিয়ে দিয়েছিলেন।তাঁর অন্তর সর্বদা মহান আল্লাহর স্মরণে এবং তাঁর ই প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকতে চাইত।অন্য সকল কিছুর চিন্তা থেকে মনকে পরিপূর্ণ ভাবে খালি করে নিজের সম্পূর্ণ দেহ,মন,আবেগ ও অনুভূতি আল্লাহর প্রতি সমর্পন করে তাঁরই স্মরণ ও প্রার্থনায় থাকতে তিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। এ ছিল তাঁর সর্বোচ্চ অবস্থা। কিন্তু কখনো কখনো স্বাভাবিক প্রয়োজনে ধর্মীয় ও জাগতিক অন্যান্য বিষয়ের প্রতি তাঁকে মনোনিবেশ করতে হতো।এরুপ মনোনিবেশ মূলত অন্যায় না হলেও তিনি একে নিজের পূর্ণতার জন্য ত্রুটি হিসেবে গণ্য করতেন।আর এইজন্য তিনি এরুপ ত্রুটির দিকে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন এবং সর্বোচ্চ অবস্থার প্রার্থনা করতেন। নিজের সর্বোচ্চ অবস্থার ত্রুটি হচ্ছে দেখে অতি প্রয়োজনে জাগতিক বা সামাজিক বিষয়ের দিকে মনোনিবেশও তিনি নিজের জন্য পাপ বলে গণ্য করতেন এবং এজন্য তিনি ক্ষমা প্রার্থনা জরুরি মনে করতেন।

খ) এছাড়া দাসত্বের প্রকাশ তো প্রার্থনাতেই (আল্লাহ্ ও তাঁর বান্দার মধ্যকার দাসত্ব ও প্রেমের মধুর সম্পর্ক যারা না বোঝে তারাই মনে করে যে, পাপ হলেই শুধু ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। পাপ হোক আর না হোক, কী জানি কী ত্রুটি হয়ে গেল, হয়তো বা মালিকের সঠিক মর্যাদা রক্ষা করতে ভুল হয়ে গিয়েছে ,হয়তো বা মালিকের স্মরণ থেকে বিচ্যুত বা বেখেয়াল হয়ে গেছি, একথা ভেবে ক্ষমা চাওয়া এবং নিজের অসহায়ত্ব ও প্রচুর অনুগ্রহ লাভের আবেগ প্রকাশে রয়েছে অতুলনীয় আত্মিক তৃপ্তি ও উন্নতি।আর এটাই হলো দাসত্বের পরিপূর্ণ প্রকাশ।আর দাসত্বের এরুপ বিনয় প্রকাশের জন্যও যীশু নিজের জন্য "সততাকে "অস্বীকার করেছেন (মার্ক ১০:১৭-১৮; লুক ১৮:১৮-১৯)।তিনি বাপ্তিস্মের সময় পাপের স্বীকৃতি প্রদান করেছেন "(মার্ক ১:৪-৯)

["যোহন ব্যপ্টাইজের বাপ্তাইজ ছিল তওবা (মন পরিবর্তন) ও পাপ মোচনের জন্য" লুক ৩:৩; মথি ৩:১১; প্রেরিতদের কার্যবিবরণী ১৯:৪; এখানে সবগুলো আয়াতই প্রমাণ করে যে,যোহন বাপ্তাইজের বাপ্তিস্ম ছিল পাপ মোচনের জন্য তওবার বা অনুতাপের বাপ্তিস্ম। আর যীশু এই বাপ্তিস্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে স্বীকার করার অর্থ এই যে,যীশু নিজের পাপ স্বীকার করে তওবা ও পাপ মোচনের বাপ্তিস্ম গ্রহণ করেছিলেন।কারণ এছাড়া যোহনের বাপ্তিস্মের মৌলিক আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না"]।এছাড়া যীশু,"আমাদের অপরাধ সব ক্ষমা কর" বলে বারংবার প্রার্থনা করেছেন" (মথি ৬:১২-১৩)।এছাড়া যীশু দাসত্বের প্রকাশের জন্য আরো বলেছেন,"ঈশ্বর আমার,ঈশ্বর আমার,তুমি কেন আমায় পরিত্যাগ করলে"(মার্ক ১৫:৩৪; মথি ২৭:৪৬)।তিনি আরো বলেছেন," আমাকে রক্ষা করা থেকে এবং আমার যন্ত্রণার উক্তি থেকে কেন তুমি দূরে থাক?আমার ঈশ্বর, আমি দিনের বেলা ডাকি, কিন্তু তুমি উত্তর দাও না এবং রাতেও আমি নিরব থাকি না!"(গীতসংহিতা ২২:১-২) ইত্যাদি।এখন এখানে খ্রিস্টানদের কাছে তবুও দুটি প্রশ্ন রেখে গেলাম তাদের মতামত জানার জন্য।

i) যীশু কী পাপী ছিলেন যার জন্য তিনি এরুপ উক্তি ব্যক্ত করেছেন?
ii) নাকি তিনি আল্লাহর দাসত্ব ও বিনয় প্রকাশের জন্য এরুপ উক্তি ব্যক্ত করেছেন?

গ) আমরা উপরোল্লিখিত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জানতে পারলাম যে,"প্রার্থনা অনেক সময় একান্ত ইবাদত হিসেবেই করা হয়। প্রোথিত বিষয় অর্জনের জন্য নয়, কেবলমাত্র মহান আল্লাহর দাসত্ব প্রকাশ ও ইবাদত পালন করাই প্রার্থনার উদ্দেশ্য হয়।এমনও হতে পারে যে ,"রাসূলুল্লাহ সাঃ এর ক্ষমা প্রার্থনার উদ্দেশ্যও ছিল এরুপ ইবাদত পালন।

ঘ) আরেকটি জোরালো সম্ভাবনা যে,তিনি তাঁর উম্মত কে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন যেন তাঁর উম্মত তাঁর অনুসরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরিপূর্ণ ধারাবাহিকতা অর্জন করতে পারে।
উপরের চারটি ব্যাখ্যার প্রত্যেকটিই জোরালো এবং গ্রহণযোগ্য। কোন ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে আপত্তি করা কিছুই নেই।আর যে সকল হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনার কথা বর্ণিত হয়েছে সে সকল হাদিসের প্রত্যেকটির ক্ষেত্রেই উপরের চারটি ব্যাখ্যার সবগুলো বা কয়েকটি প্রযোজ্য।

এভাবে আমরা দেখেছি যে,অমুসলিম নাস্তিক সহ কাফের মুশরিক খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্ধৃত আয়াত বা হাদিস দ্বারা কোনভাবেই প্রমাণ করা যায় না যে,রাসূলুল্লাহ সাঃ কোন পাপ করেছিলেন বা তিনি পাপী ছিলেন।"(নাঊযুবিল্লাহ মিনযালিক)।আর এটা থেকেই প্রমাণিত হলো যে তাদের এসব অভিযোগ মিথ্যা ও বাতিল।


Comments

Popular posts from this blog

আরবি دحا (daha),বা ধাতু دحو(dah-un) শব্দের অর্থ কী?

পর্ব: ১] আমরা হাদিস কেন মানতে বাধ্য?

কোরআন মানতে গিয়েই সহীহ হাদিস মানতে বাধ্য কেন?